
কতদিন তোমাকে দেখিনি, কতকাল তোমার স্পর্শে, তোমার গন্ধে অনুভূতিশূন্য হই না। তবুও এতকাল এ আশাটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিলাম যে, বেঁচে যদি থাকি, তোমাকে পেতেও তো পারি। কিন্তু আজ মৃত্যুভয় আমাকে সে আশাটুকু নিয়ে বাঁচার বিলাসিতাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী করে তুলেছি আমি। এতটা বছর এতগুলো মুহূর্ত গেল, কেন তোমাকে জানালাম না ভালোবাসার কথাটুকু? সেই তো ঠিকই গেলাম অবশেষে থাকতে না পেরে! নিজেকে বেঁধে রাখতে না পেরে ঠিকই ছুটে চলে গেলাম তোমার কাছে। তোমার ভালোবাসার আশ্রয়ে আশ্রিত হতে তো গেলামই! তা হলে কেন এতকাল নিজেকে কষ্ট দিলাম?
আমি তো ভালো ছিলাম না কখনওই, তা হলে কেন যাইনি আগ বাড়িয়ে? ভালোবাসার দায়টুকু তো আমারই বেশি। আমার ইগো আমাকে তোমার কাছে থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমার ব্যথার নখ আমারই বুকআঁচড়ে দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তবুও বুঝতে দিইনি কাউকেই, আমি যে কতটা কষ্ট পাচ্ছি! সেই কষ্ট তো ঠিকই পেলাম। তুমি কি ফিরিয়ে দিতে যদি হাতদুটো কিছু সময় আগে পাততাম? যদি আরও কিছুদিন আগে বেহায়া হতাম তো কী ক্ষতি ছিল? আরও কিছু আগে তা হলে একটু বেঁচে নিতাম নাহয় আমিও…ওদেরই মতো? আমার কি বাঁচার অধিকার ছিল না, আমার কি আরও একটু ভালোথাকার অধিকার ছিল না? তা হলে কেন অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়েছি? কেন নিজেই ঠকিয়েছি নিজেকে? কেন যাইনি ভালোবাসার আবদার নিয়ে একটু সুখে থাকার দাবি জানাতে? যদি দিতে ফিরিয়ে, যদি তাড়িয়ে দিতে, নাহয় তা-ই হতো। তাও তো তখন নিজেকে ঠিক বুঝিয়ে নিতাম, আমি গিয়েছি এবং চেষ্টা করেছি। আমি কী দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিই? নিজের অহংবোধে আজ নিজেকেই নিজে নিজে শেষ করেছি আমি। আমার ছোট্ট তীরে কেবলই তোমার শূন্যতা।
তুমি আজকাল অনেক অনেক ভালোবাসো আমাকে, তোমার ভালোবাসাটা আসলে বর্ণনা করার মতো কিছু না। এই যেমন, প্রতিদিনই তো খাচ্ছি, প্রতিদিনই তো বেঁচে থাকছি, মরে তো আর যাচ্ছি না, সুতরাং এই অমুক অমুক পাওয়াটা বিশেষ কিছু নয় হয়তো, মনে মনে এইসবই ভেবে থাকি আমরা। তার পর জীবনটাকে, বাঁচাটাকে টেকেন-ফর-গ্রান্টেড ধরে বাঁচতে বাঁচতে মৃত্যু এসে যখনই আমাদের দোরে কড়া নাড়ে, তখনই কেবল টের পাই, কী ভীষণ কী তীব্র একটা পাওয়া এই মানবজীবনটা!…আমার কাছে তোমার ভালোবাসাটা ঠিক এমনই। তুমি খুব যত্ন কর আজকাল আমার, দূর থেকে যা যা পারা যায়, সবই কর তুমি। তুমি খুঁজে খুঁজে সময় নিয়ে আমাকে আমার পছন্দের বইগুলো পাঠাচ্ছ। আমার একটা ল্যাপটপের দীর্ঘদিনের শখ ছিল এবং তার দরকারও ছিল, কিন্তু কিছুতেই কিনে উঠতে পারছিলাম না। আমি আশা করিনি, আমি ওটা চাইওনি তোমার কাছে, তবু তুমি ঠিকই কিনে দিলে। জানো, ল্যাপটপটা বাসায় আনার পর যখন তোমাকে দেখাবার জন্য ছবি তুলছিলাম, তখন এত আনন্দ হচ্ছিল যে, আমি কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি। যদিও যেকোনও বিলাসী বস্তুই আমার কাছে মূল্যহীন, কিন্তু এটা ছিল দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বস্তু।
আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাইনি। আসলে ধন্যবাদ দেবার যোগ্যতা, অথবা ধন্যবাদের যোগ্য সব ভাষাই, তোমার বেলায়, আমার কাছে ভীষণ অযোগ্য। আমি কেন দেবো তোমাকে ধন্যবাদ? তুমি যখনই এটাকে তোমার দায়িত্ব ভেবেছ, আমি তখনই এটাকে আমার অধিকার ভেবে নিয়েছি। আমার চারপাশে অনেক গাছ ছিল এতদিন, গাছের ছায়াও ছিল বেশ, কিন্তু সে গাছের ছায়ায় আমার জায়গা হয়নি ছিটেফোঁটাও, কেন যেন আমার বেলাতেই সব কিছু কম পড়ে যেত। আমি দেখতাম, ওদের কার কার কী কী লাগবে, যদিও আজ পর্যন্ত ওদের কাউকেই আমার সেরাটা দিয়েও খুশি করতে পারিনি। আর যখন ওদের জন্য নিজের অধিকারটুকু, নিজের প্রয়োজনটুকু ছেড়ে দিতাম, তখন নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ মহৎ মনে হতো, জানো? আর সুযোগ পেলে অমন মহৎ হতে কে না চাইবে? আমি আসলে সব সময় আমার স্রষ্টার কাছে হাত তুলে চেয়ে চেয়ে সামনে এগোনর শক্তি সঞ্চয় করে হেঁটেছি। আমি জানতাম, আমি সব সময় জানতাম, আমার মাথার ছাদ নড়বড়ে, আমার পায়ের নিচের মাটি আলগা। আমার স্রষ্টার সাহায্য ছাড়া, বিশ্বাস করো, আমি আর এক পা-ও এগুতে পারতাম না।
গাছ কিন্তু অনেকই থাকে, সব গাছ ছায়া দেয় না। তুমি আমাকে এটা সেটা দিয়ে পাগল করে রাখ, কিছুদিন তোমার উপহারের বহরের নিচে দম আটকে হাঁসফাঁস করতে থাকি, তার পর…তোমার শূন্যতা আবার আমাকে জাপটে ধরে। ভয় হয়, ভীষণ ভয় হয়। এতদিন ভয় পেতাম কী করতে কী করে বসব, তার পর তুমি রেগে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! তখনও মৃত্যুর ভয়টা ওভাবে ভেবে দেখতে বাধ্য হইনি। অথচ আজ মনে হয়, আজ ভয় হয়…মৃত্যুর আগে কি শেষবারের মতো হলেও তোমার স্পর্শটা পাব না? তোমার সাথে কত রাগ দেখাই, অভিযোগ করি, ভীষণ অভিমানে থেকে মুখগোমড়া করে কথা না বলে তোমাকে কষ্ট দেবার উদ্দেশ্যেই বসে থাকি, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্ট নিজে পাই। তুমি এটা বুঝতে পার? আজ মনে হয়, আজ বুঝতে বাকি নেই যে, ওই সময়টুকুও বৃথাই বরবাদ গেছে। জানো, আজকে থেকে তুমি আমাকে যত খুশি বকো, যত খুশি আমাকে সময় না দিয়ে ব্যস্ত থাকো অন্য কাজে, অন্য কোথাও আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য থাকো, তবু আমি অভিযোগ তুলব না, অভিমান করে মুখফুলিয়ে বসে থাকব না। আমি রাগব না, আমি চলে যেতে চাইব না, আমি তোমার সব কিছু মেনে নেব।
আজ আমার সময় অনেক অনেক অল্প। যেটুকু সময় আছে, যেটুকু সময় পাই, আমি তোমাকে ভালোবাসব শুধুই। তুমি আমাকে যতটা তীব্রভাবে স্পর্শ কর, আদর করে দাও, ঠিক ততটা তীব্রতা নিয়ে আমাকে বোকো আজকে থেকে। আমাকে তোমার যা খুশি, যা যা ইচ্ছে হয় বোলো, যা যা ইচ্ছে হয় কোরো। উঠতে-বসতে আমার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যে ভুলগুলো হয়, সেগুলোও একটা একটা করে ধরিয়ে দাও, আমাকে শাস্তি দাও, আমাকে লজ্জা দাও, আমি তবুও কিচ্ছু বলব না। আমি তোমার সবটা নিয়েই তোমাকে চাই আজকে। আমার তোমার সবটাই চাই। যে কটা দিন বেঁচে আছি, তোমার সবটুকু নিয়ে বেঁচে যেতে চাই। এই আশাটুকু তোমার চোখে অনেক ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এটাই সারাজীবনের পাওয়া। কখনও ভুলেও ভেবে নিয়ো না যে, তুমি আমার আগে চলে যাবে। আমি তা হলে রোজ-কিয়ামতের দিন আমার স্রষ্টার কাছে বিচার চাইব। আমার স্রষ্টাকে বলব, এই মানুষটি আমাকে কথা দিয়েছিল, আমরা একসঙ্গে বাঁচব, কিন্তু এই মানুষটি আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আমি শেষবিচারের দিন তোমার বিচার চাইব। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কোন মানুষটা কেবলই আমার, বলো?
আমাকে একলা রেখে চলে যাবে কার কাছে? বরং আমি যদি আগে চলে যাই, তুমি ঠিকই একটা না একটা অজুহাতে বেঁচে থাকতে পারবে। আমার যে সব অজুহাত কেবলই তুমি। এতদিন আমি একবুক কষ্ট আর ক্ষোভ নিয়ে কাঁদতাম, কিন্তু আজ আমি আনন্দে আন্দোলিত হয়ে কাঁদি। কান্না ঠিকই আছে, কেবল উৎস আর কারণ বদলে গেছে। তুমি ভেবো না, আমাকে ছেড়ে আগে চলে গেলেই বেঁচে যাবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও কি তুমি ভালো থাকবে? একআকাশ তারা এতটা কাল আমি একা একা দেখতাম, আজকে তুমি পাশে না থাকলেও যখনই যা-কিছু দেখি, তোমাকে সব কিছুতে অনুভব করি। আজ আমার চোখে সব কিছু স্বচ্ছ, সুন্দর, কোমল, নরম। আমার বন্ধদুয়ারে আজ আমার আর একলা লাগে না। আজ আমার কথায় কথায় মরে যেতে মন চায় না। মানুষের জীবনে হিসেবগুলো কত দ্রুত বদলায়! আমি বেশ থাকি আজকাল, তোমাকে নিয়ে। আমি হয়তো কোনও পার্থিব সফলতা পাইনি, কিন্তু আমি যে তোমাকে পেয়েছি, এটাকে তুমি কী বলবে? আর একটা জিনিস জানো? আমার তোমাকে এখানে, এই পৃথিবীতে একলা ফেলে রেখে যেতে ভয় করে, যদি তোমার দম বন্ধ হয়ে আসে কখনও? যদি তুমি কষ্ট পাও কখনও আবার? তখন তোমাকে কে সামলাবে? আমার মতো এতটা আদর দিয়ে কেউ কি পারবে কাছে টেনে নিতে? যদি পারে তা হলে আর চিন্তা নেই, কিন্তু যদি না পারে, তবে কার ভরসায় রেখে যাব তোমাকে, একা? আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না। জেনো, একসময় বেলাও ফুরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা যেকোনও অজুহাতে বেঁচে থাকেই। সংগ্রহ ইন্টারনেট