
পিরোজপুর জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসপিরোজপুর জেলা (বরিশাল বিভাগ) আয়তন: ১৩৯৯.৩৯ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২২°০৯´ থেকে ২২°৫২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৫২´ থেকে ৯০°১৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা, পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা।
জনসংখ্যা ১১১১০৬৮; পুরুষ ৫৬১৯৭২, মহিলা ৫৪৯০৯৬। মুসলিম ৯০৩৯৫২, হিন্দু ২০৬৪৬৮, বৌদ্ধ ১৯৫, খ্রিস্টান ১৬০ এবং অন্যান্য ২৯৩।
নামকরণ:
পিরোজপুর নাম কবে কিভাবে কিসের ভিত্তিতে নিরুপিত বা নির্দিষ্ট হয়েছে তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য বা ইতিহাস জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ অনুসন্ধান বা ইতিহাস গবেষণালব্ধ উপসংহারে অনুমিত হয়েছে যে, ফিরোজ নামের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নামকে স্মৃতিময় করে রাখার প্রয়াসে এই জায়গার নাম ফিরোজপুর হয়েছিল। ফিরোজ শাহের আমল থেকে ভাটির দেশের ফিরোজপুর, বেনিয়া চক্রের ছোঁয়া লেগে পাল্টে হলো পিরোজপুর।’’
পিরোজপুর নামকরণের একটা সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নাজিরপুর উপজেলার শাখারী কাঠির জনৈক হেলালউদ্দীন মোঘল নিজেকে মোঘল বংশের শেষ বংশধর হিসেবে দাবী করেছিলেন। তাঁর মতে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আত্মগোপনের এক পর্যায়ে নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয় এবং শাহ্ সুজা তার দুই কন্যাসহ আরাকানে পালিয়ে যান।
সেখানে তিনি অপর এক রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী এক শিশু পুত্রসহ থেকে যায়। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে পশ্চিমে চলে এসে বর্তমান পিরোজপুরের পার্শ্ববর্তী দামোদর নদীর মুখে আস্তানা তৈরি করেন। এ শিশুর নাম ছিল ফিরোজ এবং তার নাম অনুসারে নাম হয় ফিরোজপুর। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক কথ্য ভাষার উচ্চারণগত বিচ্যুতিতে এক সময়ের ফিরোজপুর নামটি পিরোজপুর নামে প্রবর্তিত হয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলি:
এ জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার সিংখালিতে ১৭৫৭ সালে কৃষক বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন যুগপৎ চালাবার প্রস্তাব পাশ হলে পিরোজপুরেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চাখারের উকিল মফিজউদ্দিন ও সৈয়দ হাবিবুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালে ‘কুলকাঠি হত্যাকান্ড’-র প্রতিবাদে পিরোজপুরে আন্দোলন সংগঠিত হয়।
১৯৭১ সালে আগস্ট মাসে সুবাদার আজিজ সিকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভান্ডারিয়া উপজেলার ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে। ২৯ নভেম্বর ভান্ডারিয়া বন্দর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে এই উপজেলা থেকে পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাটি ছিল। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা কাউখালী থানা আক্রমণ করে অস্ত দখল করে নেয়।এছাড়াও সেপ্টেম্বর মাসে কেউন্দিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের লড়াইয়ে ১৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া আমড়াঝুড়িতে পাকসেনারা ৩০ জন লোককে হত্যা করে এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
পিরোজপুর সদর উপজেলায় পাকসেনাদের সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য সরবরাহের অপরাধে ভাগীরথী (বীরাঙ্গনা)-কে পাকসেনারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় মোটর সাইকেলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে মৃত্যু ঘটিয়ে তার লাশ বলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়। মঠবাড়ীয়া উপজেলায় মে মাসে ঝাটিপুনিয়া নামক স্থানে রাজাককারবাহিনী ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। নাজিরপুর উপজেলায় ১৫ মে পাকসেনারা দীর্ঘা ইউনিয়নে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। ৩ ডিসেম্বর রাজাকার ও পাকসেনারা সাতকাছেমিয়া ও বাইনকাঠি গ্রামে ৭ জন লোককে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১১ মে নেছারাবাদ উপজেলায় পাকসেনারা সর্বপ্রথম আক্রমণ করে। মে-জুন মাসে পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় মিয়ারহাট ও ইন্দেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন গ্রামের বাড়িঘর ও দোকানে ব্যাপক লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
ভাষা ও সংস্কৃতি:
পিরোজপুরের ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বরিশাল ও খুলনার মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় এই দুই অঞ্চলের ভাষার দ্যোতনা পরিলক্ষিত হয় পিরোজপুরের ভাষায়। তবে পিরোজপুরের কোন আঞ্চলিক ভাষা নেই, নেই কোন বিশেষ ভাষা-ভাষী গোষ্ঠী। ১৭শ ও ১৮শ শতকে বাকলার পান্ডিত্য গৌরব সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানকার প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব, আবুল হাসান, ক্ষেত্রগুপ্ত, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, এমদাদ আলী ফিরোজী, এম এ বারী,শেখ শহীদুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মোসলেহ্ উদ্দিনের নাম স্ব-মহিমায় দোদীপ্যমান।প্রবাদ প্রবচন ও বিয়ের গানের জন্য পিরোজপুর বিখ্যাত। বর্তমানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী,সংগীতা, ধ্বনি শিল্পী গোষ্ঠী, রুপান্তর নাট্য গোষ্ঠী, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্যম্ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আঞ্চলিক ঐতিহ্য লালন পালন ও প্রচারে একাগ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পিরোজপুর অফিসার্স ক্লাব, গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব, বলাকা ক্লাব সহ প্রভৃতি অঙ্গসংগঠন পিরোজপুরে ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভুমিকা রাখছে।
পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক জনগণ:
(১৯৯২), সাপ্তাহিক: ভান্ডারিয়া বার্তা, পিরোজপুর মুক্তবার্তা (১৯৯৮), পিরোজপুর দর্পণ (১৯৮৫), বলেশ্বরী (১৯৯৮), পিরোজপুর বাণী (১৯৯৩), পাক্ষিক: মঠবাড়ীয়া সমাচার (১৯৯৭)। অবুলপ্ত: উপকূুল সমাচার, পিরোজপুর হিতৈষী, পরিচিতি, মুকুল, ধূুমকেতু, জনমত, দক্ষিণ দেশ, বাংলাদেশ, লালবার্তা, অন্যতম, প্রদীপ, ধলেশ্বর।
র্শনীয় স্থান:-
পিরোজপুর জেলার পর্যটন ঐতিয্য পিরোজপুরের প্রাচীন মসজিদঃপিরোজপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি আজ থেকে প্রায় ২শত ২০ বছর পূর্বে স্থাপিত হয়। ১৮৮২ সালে ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের হাফেজ মোহাম্মদ সোলায়মান এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পাশাপাশি শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় ২০ শতাংশ জমি ক্রয় করে গোলপাতার ছাউনী দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। গোলপাতার তৈরি মসজিদটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আপ্রাণ চেষ্টায় র আর্থিক সাহায্যে ১৮৯৪ সালের দিকে পর্যায়ক্রমে দালানে উন্নীত হয়। ইয়াসিন সর্দার নামক এক ব্যক্তির কবর এখনও মসজিদের ভিতরে অবস্থিত। তিনি এই মসজিদের অন্যতম একজন খাদেম ছিলেন।