
ফুটবল বিশ্বকাপকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আসর। বিশ্বের সেরা সব ফুটবল খেলুড়ে দেশ শিরোপার জন্য লড়াইয়ে নামে। বাছাইপর্ব পেরিয়ে মূল আসরে নামা দলগুলোর মধ্যে মাত্র একটি দল ‘চ্যাম্পিয়ন’র সম্মান অর্জন করে আর পরবর্তী চার বছরের জন্য তা ধরে রাখার সুযোগ অর্জন করে।
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় উরুগুয়েতে। সেই থেকে সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা অধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে চার বছর পর পর এই বিশ্ব আসর উপভোগ করার জন্য। ১৯৪২ আর ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে মাঠে গড়ায়নি বিশ্বকাপ। তার মানে সেই থেকে বিশ্বকাপের ২০টি আসর মাঠে গড়িয়েছে। ২১তম বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া। এখন পর্যন্ত ৮টি দল ফাইনাল জিতে শিরোপা স্বাদ গ্রহণ করেছে। আজ কি তাতে আরও একটি নাম যুক্ত হবে, নাকি আগে জেতা দলই আবার শিরোপা তুলে ধরবে?
ব্রাজিল-৫ ফাইনালে বিজয়ী বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল এখন পর্যন্ত ব্রাজিল। এর আগে ২০টি ফাইনালের ৭টিতেই খেলেছে তারা। জিতেছে ৫টি শিরোপা। তারাই একমাত্র দল যারা সবগুলো আসরেই অংশ নিয়েছে। ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় সেলেসাওরা। ওই বিশ্বকাপে পরবর্তীতে সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলের দর্শন পায় ফুটবলবিশ্ব। ১৯৬২ সালে আবারও শিরোপা জয় করে দক্ষিণ আমেরিকার দলটি। একই কীর্তি আছে শুধু ইতালির। ১৯৫০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে তৃতীয় শিরোপা অর্জন করে ব্রাজিল। এটা পেলেরও তৃতীয় শিরোপা।
ব্রাজিল প্রথমবারের মতো নিজেদের দেশে আয়োজিত ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে শিরোপার খুব কাছে পৌঁছায়। ব্রাজিলের শহর রিও ডি জেনিরিওতে অবস্থিত বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে উরুগুয়ের মোকাবেলা করে দলটি। ওই ম্যাচে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৪ জন দর্শকের সামনে নিজেদের প্রথম শিরোপা জয়ের একদম শেষ প্রান্তে খালি হাতে ফেরে সেলেসাওরা। এরপর তাদের প্রথম শিরোপার স্বাদ পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয় ৮ বছর।
১৯৭০ সালের পর ২৪ বছর শিরোপার স্বাদ পায়নি ব্রাজিল। ১৯৯৪ সালে কিংবদন্তি রোমারিও জাদুতে ফের সেই স্বাদ পায় তারা। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে শিরোপা স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হলেও ২০০২ সালে নিজেদের পঞ্চম ও এখন পর্যন্ত শেষবারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তোলে রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো, বেবেতো, রবার্তো কার্লোস, কাফু সমৃদ্ধ ব্রাজল।
জার্মানি-৪ ফাইনালে বিজয়ী সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দল জার্মানি। এখন পর্যন্ত ৮বার ফাইনাল খেলেছে দলটি। পশ্চিম জার্মানি নামে তারা ৬টি বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে ৩টিতেই জয় পায়। ১৯৯০ সালের পর তারা জার্মানি নামে অংশ নিয়ে ২বার ফাইনাল খেলে ১বার শিরোপা ঘরে তোলে।
১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় জার্মানরা। ফাইনালে সে সময়ের দুর্দান্ত হাঙ্গেরি দলের মুখোমুখি হয় তারা। এই হাঙ্গেরির কাছে গ্রুপ পর্বে ৮-৩ গোলের পরাজয় বরণ করা সত্ত্বেও ফাইনালে তাদেরই ৩-২ গোলে হারিয়ে দেয় জার্মানরা। এরপর ২০ বছর পর ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে স্বাগতিক জার্মানদের হাতেই উঠে শিরোপা।
এরপরের চার বিশ্বকাপের তিনটিতেই ফাইনালে পা রাখে জার্মান দল। প্রথমবার ইতালি, দ্বিতীয়বার আর্জেন্টিনার কাছে হারের পর তৃতীয়বারে তথা ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে জার্মানরা।
জার্মানির পরবর্তী ফাইনাল ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে। ব্রাজিলের জন্য সেটি টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল। ওই ম্যাচে ২-০ গোলে হেরে যায় জার্মানি এবং অবশেষে ২০১৪ সালে ঠিক ২৪ বছর পর নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে জার্মানরা।
ইতালি-৪ ফাইনালে জয়ী ইতালি হচ্ছে সেই দল যারা সারা বিশ্বকে ‘বিশেষ কৌশলী রক্ষণ’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ৬বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে ৪বার শিরোপা জয় করে ব্রাজিল-জার্মানির পাশাপাশি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা সফল দলের তালিকায় নাম লেখায় তারা।
১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে টানা দুই বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে ইতালি। প্রথমবার চেকস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় পায় সেবারের স্বাগতিক ইতালি। দ্বিতীয়বার তারা হাঙ্গেরিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা দুই শিরোপা জয়ী প্রথম দলে পরিণত হয় তারা। পরে ব্রাজিলও এই তালিকায় নাম লেখায়।
১৯৩৮ সালের পর তৃতীয় শিরোপা জিততে ৪৪ বছর অপেক্ষায় থাকতে হয় ইতালিকে। এর মাঝে একবার বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ৪-১ গোলে হেরে যায় তারা। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে তারা পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে তৃতীয় শিরোপা জিতে নেয়। এরপর আরও ২৪ বছর পর ২০০৬ সালে চতুর্থ শিরোপা ঘরে তোলে ইতালি।
আর্জেন্টিনা-২ ফাইনালজয়ী আর্জেন্টিনা ৫বার বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছে, যার দুটিতে জিতে শিরোপা জয় করে তারা। ১৯৭৮ সালের ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে ৩-১ ব্যবধানে নেদারল্যান্ডসকে হারায় তারা। এরপর মাত্র ৮ বছর পর দিয়েগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে নিজেদের দ্বিতীয় ও এখন পর্যন্ত শেষ শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টাইনরা। ১৯৮৬ সালের ওই আসরেই কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’র কল্যাণে ইংলিশদের হারায় তারা।
উরুগুয়ে-২ ফাইনালে জয়ী বিশ্বকাপের ফাইনালে দুইবার পা রেখে দুইবারই শিরোপা জেতার স্বাদ পায় উরুগুয়ে। তবে তারাই সবচেয় বেশিবার শিরোপাশূন্য দলের তকমাধারী (১৯৫০-বর্তমান)।
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ আসরে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ট্রফি জিতে যায় স্বাগতিক উরুগুয়ে। এরপর একযুগ পর আয়োজিত বিশ্বকাপ (এর মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আয়োজন বন্ধ থাকে) আসরে নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় উরুগুয়ে। ১৯৫০ সালের ওই আসরে তারা দ্বিতীয়বারের মতো জুলে রিমে ট্রফি জয়ে করে। সেই থেকে তাদের তৃতীয় শিরোপার সন্ধান চলছেই।
ইংল্যান্ড-১ ফাইনালে জয়ী ইংল্যান্ড, যারা আধুনিক বিশ্বকাপের আবিস্কারক হিসেবে দাবি করে, তারা তাদের একমাত্র শিরোপাটি অর্জন করে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে। ফাইনালে স্যার জিউফ হার্স্টের হ্যাটট্রিকে শিরোপা নিশ্চিত হয় ইংলিশদের। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে সেটিই একমাত্র হ্যাটট্রিক।
ফ্রান্স-১ ফাইনালে জয়ী ১৯৯৮ সালে নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র শিরোপাটি জিতেছে ফ্রান্স। ফাইনালে জিনেদিন জিদানের জোড়া গোলে ৩-০ ব্যবধানে তারা ব্রাজিলকে হারিয়ে দেয়। ২০০৬ সালের ফাইনালে তাদের সামনে আবারও সুযোগ আসে, কিন্তু জিনেদিন জিদানের ‘ঢুস’ কাণ্ডে লাল কার্ড খাওয়া আর পেনাল্টি শুট আউটে ইতালির কাছে পরাস্ত হয়ে হয় তাদের। আজ (১৫ জুলাই) রাতে আবারও তাদের সামনে শিরোপা জয়ের সুযোগ থাকছে। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচটি তাদের জন্য কতটা সৌভাগ্য বয়ে আনে তাই দেখার অপেক্ষা।
স্পেন-১ ফাইনালে জয়ী টিকি-টাকা আর পাসিং ফুটবলের পূঁজারি স্পেন দল ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে নিজেদের একমাত্র শিরোপাটি জয় করে। ফাইনালে তারা নেদারল্যান্ডসকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা ঘরে তোলে। তবে এবারের রাশিয়া আসর ও এর আগের ব্রাজিল বিশ্বকাপেও তাদের টিকি-টাকাকে অকার্যকর বলে মনে হয়েছে। ভবিষ্যতে তাদের হয়তো অন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।