প্রায় দুই মাস ধরে কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন বিএনপি। বিশেষ করে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ মার্চ চেয়ারপারসনের সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে হঠাৎ তা বাতিল করায় এই উদ্বেগ বেড়েছে। তৃণমূল থেকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা তাদের নেত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তারা জানতে চাইছেন বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার আসল তথ্য। বিএনপির দাবি অবিলম্বে তাদের চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। তা না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সরকারকে সব দায় নিতে হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বলেন, ’৭৩ বছর বয়স্ক জনপ্রিয় নেত্রীর শারীরিক অবস্থা এখন প্রকৃতপক্ষে কেমন সেটিও আমরা জানতে পারছি না। এমনকি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের সুচিকিৎসা দিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে।
এ দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সিনিয়র নাগরিকেরাও। তারা খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কয়েকজন সিনিয়র নাগরিক খালেদা জিয়ার সাথে কারাগারে সাক্ষাৎ করার জন্য গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি প্রিজনের কাছে আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত পাঁচ বছরের সাজা দেন। সেদিন থেকেই পুরনো ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী তিনি। তার মুক্তির দাবিতে বিােভ, মানববন্ধন, গণ-অনশন, গণস্বার সংগ্রহ, জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় বিভাগীয় শহরগুলোতেও বিএনপির জনসভা শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে খুলনা ও চট্টগ্রামে সমাবেশ হয়েছে। বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীতেও জনসভার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। এ দিকে খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর তার সাথে পরিবারের সদস্যরা কয়েক দফা সাক্ষাৎ করেছেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন তার বোনের ছেলে শাহরিয়ার আক্তার ডন, সাজিদ ইসলাম ও ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর শাশুড়ি মুখলেমা রাজাসহ আরো একজন। ওইদিন মহিলা দলের কিছু নেত্রী দেখা করতে গেলেও তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি।
১০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী ও জয়নুল আবেদীন। ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়াকে দেখতে যান ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: ফরহাদ হালিম ডোনার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানসহ কয়েকজন। কিন্তু অনুমতি না থাকায় তারাও খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ পাননি। এরপর গত ৭ মার্চ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সাথে কারাগারে সাক্ষাৎ করেন। পরে বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা দেখা করেছেন।
সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার হঠাৎ অসুস্থতার খবরে কারা কর্তৃপক্ষ এই সাক্ষাৎ বাতিল করে। পরের দিন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সংবাদই পাইনি তার অসুস্থটা কী এবং কারা তাকে স্বাস্থ্য পরীা করছেন এবং কিভাবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই বিষয়ে কারা কর্তৃপ ও সরকারের কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। সেজন্য অতি দ্রুত ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের দিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীা এবং তাকে মুক্তি দিয়ে উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপর সর্বোচ্চ জুলুম করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে, সরকারের সব অপকর্ম, দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মুখ বন্ধ করতেই খালেদা জিয়ার জামিনসহ সব অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিচ্ছে সরকার। কিন্তু মামলায় জামিন পাওয়া মানুষের অধিকার। বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। সরকার প্রধানের নির্দেশে সে জামিন স্থগিত করা মানবধিকারের চরম লঙ্ঘন। জেলখানায় বেগম খালেদা জিয়ার প্রাপ্য অধিকার থেকে পর্যন্ত তাকে বঞ্চিত করছে সরকার। দেশবাসী অবিলম্বে তার নিঃশর্ত মুক্তি চান। এখন তার মুক্তি নিয়ে যে টালবাহানা চলছে, তাতে জনগণের মধ্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারকে বলতে চাই- অবিলম্বে দেশনেত্রীর কারামুক্তি নিয়ে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র বন্ধ করুন, আর যদি না করেন তাহলে কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
দেখা করতে চান ৪ জন সিনিয়র নাগরিক : এ দিকে অসুস্থ খালেদা জিয়ার সাথে দেখার করার জন্য গতকাল বিশিষ্ট চার নাগরিক আবেদন করেছেন তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ এবং সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে মাহফুজ উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বহির্প্রকাশ ঘটেছে। আমরা তো দেখি যে অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে থাকেন। কিন্তু খালেদা জিয়া দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বয়স্ক নারী। তিনি ব্যক্তিগত ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। কিন্তু তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আসলে খালেদা জিয়াকে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করার জন্য সরকার এসব করছে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে দায় সরকারকেই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন মাহফুজ উল্লাহ।