
রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা:লেখাটা কে, কখন, কোথায় লিখেছে কে জানে। তবে হিম্মত আছে মেয়ের। সাবাস!!“গত ২১ সেপ্টেম্বর, আজ থেকে মাত্র ৩ বছর আগে, ২০১৪ সালের ঐ একই দিনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ ISAQ (International Star for Quality Convention) Award পায়। এটি সারা বিশ্বে অত্যন্ত prestigious award গুলির একটি :)জ্বী, হ্যাঁ। আপনাদের ভাষায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় “পতিতালয়”টি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা তার শিক্ষার মানের জন্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করে বাংলাদেশের অর্জনের পাল্লা কে ভারী করেছিলো।
এই “পতিতালয়” বা “porn industry”টিই বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরেছিলো শুধু মাত্র তার শিক্ষার মানের জন্য। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত HSC পরীক্ষায় প্রায় ৭বার combined merit list এ প্রথম স্থান দখল করেছিলো এই “পতিতালয়” এ অধ্যয়নরত “পতিতা”গুলো। এই “পতিতা তৈরীর কারখানা” International School Award (British Council) সহ আরও নানা মর্যাদায় ভূষিত। আপনি যখন VNSC এর মেয়েদের কে “পতিতা” বলছেন, তখন বাংলাদেশের মাত্র ২৫,০০০ এর বেশী (এক্স ভিকি বাদে) কিছু মেয়ে কে পতিতা বলছেন। এর মধ্যে অনেক “পতিতা” প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, নারায়ণগঞ্জ এবং আরও অনেক দূরের এলাকা থেকে বাসে বা অন্য যানবাহনে ক্লাস করতে আসে ।
আর এই বেইলী রোডে, ধানমন্ডিতে, আজিমপুর ও বসুন্ধরা-চারটি ব্রাঞ্চের মেয়েরা ক্লাস, কোচিং করে সন্ধ্যা বা রাতে বাড়ি ফিরে আবার মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থেকে কলেজ বা স্কুলের কাজ /এসাইনমেন্ট গুলো শেষ করে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে।আপনি যখন বলেন “এদের কে ধরে ধরে ধর্ষণ করা উচিত” তখন আমি বাসে গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার রুপার ধর্ষকদের শাস্তি হওয়ার কোনো অর্থ দেখতে পাই না। কারণ বাঙালীর এই মনোভাব হীরক খণ্ডের কার্বনের মত দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ, ফাঁসি বা জেল দিয়ে কি তা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব? আমার অনেক ক্লাসমেট, ওহ সরি, আপনাদের ভাষায় “পতিতা”রা full free বা half free scholarship নিয়ে নিজের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মজীবী বাবার “বোঝা” থেকে “গর্ব” হবার একমাত্র আশার আলো নিয়ে এই স্কুলটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে…… কারণ এটাই তো আমাদের সেকেন্ড হোম :)! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত….. নিজের সাথে, নিজের জীবনের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যায় এই “পতিতা” গুলো। Viqarunnisa Noon School And College একটি বিশাল পরিবার যার সবচেয়ে ছোটো সদস্যরা ৫-৬বছর বয়সী শিশু।
আপনি যখন বলেন, “ওদের কে ধরে ধরে ধর্ষণ করা হোক” তখন আমার মনে হয়, হয়তো বা স্বর্গ থেকেও ৫ বছর বয়সী শিশু পূজার আত্মাও কেঁপে ওঠে……. কারণ সে জানে তার দলে যোগ হতে চলেছে আরও অনেকে, আরও অনেক নিকৃষ্ট ভাবে। কারণ ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ বড় করে, সিগারেটের ছ্যাঁক দিয়ে ১৮ ঘণ্টা ব্যাপী গণধর্ষণের শিকার হয়ে আইসিউ তে শুয়ে থেকে তার নির্মম মৃত্যুর পরও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি এই সমাজের “সুশীল” নরপশুদের মনোভাব। আপনার মতে VNSC থেকে শুধু “শূকর ছানা” বের হয়, এটা “খা*কি মা*” তৈরীর কারখানা। তবে আপনাকে আমি এটুকু জানাতে চাই যে এই “খা*কি মা*” তৈরীর কারখানাতে আমার একটি মাত্র কিডনি নিয়ে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করতে আসা সহপাঠী আর প্রতি বছর মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ও পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে চান্স পাওয়া শত সহস্র মেয়ের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করে “পতিতাবৃত্তি” করে তাদের জীবন গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ১২ বছরে ১২ বার সেকশন চেইঞ্জ হয়, প্রতিবছর নতুন করে এক শতাধিক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় সেই সুবাদে। আমি আমার এই ২৫০০০ শিক্ষার্থীতে সম্পদশালী “পতিতালয়” থেকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছি।
আমাদের “বিদ্যালয়” কেমন সেটা ১২টা বছর এই বিদ্যালয়ের সাথে যারা আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ শুধু তারাই জানে, এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট পাথরে প্রতিটি মেয়ের জীবনের আলাদা আলাদা সংগ্রামের কাহিনী, সুখ-দুঃখের কাহিনী কিভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। এমন কিছু গল্পের উদাহরণ দেখতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের Anika Tahsin আপুর লিখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন। খোঁজ খবর নিন, উনার মত আরও অনেক কে পাবেন। সবশেষে এটা বলবো যে, এই ফেইসবুকে আপনার করা মন্তব্য গুলো ১৩বছর বয়সী বালিকা থেকে শুরু করে সবাই দেখতে পাচ্ছে, যাদের মধ্যে সবার হয়তো সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা নেই। যেই একজন লাবিব আত্মহত্যার জন্য মেহজাবিন এর ফাঁসি চাচ্ছেন, সেই অযুহাতে আপনাদের করা মানসিক, সামাজিক নির্যাতনের জন্য যদি কোনো ১৩-১৪ বছর বয়সী কিশোরী যার সাথে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই বা অন্য কোনো Viqi আত্মহত্যা করে, তাহলে আপনার ফাঁসির দায়িত্ব কে নিবে? নিজেকে মেহজাবিনের চেয়ে “উত্তম” প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন?
কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য/ পোস্ট করা, শিক্ষার্থীদের উত্যক্ত করা সাইবার ক্রাইমের অন্তর্গত। কারো মুখের কথা ভেবে চিন্তে প্রকাশ না করলে তার প্রভাব বা অর্থ কি হয়ে দাঁড়াতে পারে সে জিনিস বোঝার মত মানসিক ক্ষমতা বোধহয় এই “সমাজ” এর নেই। তবুও দিনশেষে আমরা, এই ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে অধ্যয়নরত পতিতারাই সমাজটা পরিবর্তনের দিবাস্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকি।
তাই আমাদের স্কুলের “মানবতা”সহ নানা সামাজিক সহযোগীতামূলক ক্লাব এর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করি, শুধু একটি আশা নিয়ে, হয়তো “পরিবর্তন” সত্যিই সম্ভব। তারপরও আপনারা নিজেদের কী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন জানি না, ইভেন্ট খুলে বসেন আমাদের প্রতিষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করে। ভারতের সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের সাথে তুলনা করেন। কতটা ত্যাগ স্বীকার করে এই প্রতিষ্ঠানকে আমরা ভালবেসে যাই, সেটার হিসেব কেউ রাখে? দুনিয়ার আর কোন প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে হয়তো এত ট্রল আর ব্যঙ্গ করা হয় না! মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত করা হয় এভাবে, আপনাদের বিবেকে একবার ও বাঁধে না?? যখন আপনাদের মেয়ে থাকবে, তখন তো ঠিকই আসবেন এখানে ভর্তি করাইতে!! আমি গর্বিত যে আমি ভিকারুননিসার ছাত্রী!!”
লেখাটা পাওয়ার পর আমি এভাবেই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। কতোটা মানসিক কষ্ট থেকে মেয়েটা এইভাবে লিখেছে ভাবা যায়? ইডেন কলেজের একজন ছাত্রীর ঠিক এই রকম একটা লেখাও আমি পড়েছি। সংগ্রহে থাকলে আমার পাঠক/পাঠিকাদের জন্য সেটাও এখানে উপস্থাপন করতাম।
অনার্সে পড়াকালিন সময়ে একদিন লেজার টাইমে কয়েকজন ক্লাসমেটের সাথে কলেজের পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এক ক্লাসমেট মন খারাপ করে এসে কিছুক্ষণ পর আমাদের সাথে যোগ দিলো। আরেকজন মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে বলল, মেয়েটা কিছুতেই আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না রে দোস্ত। আরেকজন খুব তাচ্ছিল্য ভরে জবাব দিলো, “পড়ে তো ওই পতিতালয়ে, না? বুঝলাম না, যে কলেজের মেয়েদের সবাই এড়িয়ে চলে, পারতঃপক্ষে কেউ বিয়ে করতে চাই না, সেই জায়গার মেয়ের পাল্লাই তুই ক্যামনে পড়লি, কে জানে। এই বার তোর জীবনটা নিশ্চিত হেল করে ছাড়বে”।
প্রথমে আমি ধরতে পারিনি কোন কলেজের কথা বলছে। পরে যখব বুঝতে পারলাম প্রতিবাদ করে উঠলাম, (বিধবা কলেজের বিধবা থাকাকালিন আমি প্রতিবাদ করতে না পারলেও তখন আমি প্রতিবাদ করা শিখে গেছি) এইসব কী ভাষা বলিস তোরা? ওটা যে পতিতালয় তোরা জানলি ক্যামনে? কাস্টমার হিসেবে গেছিস নাকি কোনদিন? রিফিউজ হয়ে ফিরে এসেছিস বলে এতো ঝাল ঝাড়ছিস? এক কথায় দুই কথায় পরিস্থিতি খুব ঘোলাটে হয়ে গেলো। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, একটা ছেলে বাদে অন্য কোন ছেলে বা মেয়ে আমার পক্ষ নিলো না।
আমাদের সমাজে ধর্ষণ, খুন, হত্যা, ইভটিজিং, র্যাগিং হর হামেশা হতেই থাকে। সেটা নিয়ে কাজ হোক বা না হোক কম বেশি প্রতিবাদ হয়তো হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ট্রলের সম্মুখিন হলে একটা মেয়ের মনের অবস্থা কী হয় তা কেউ বোঝার চেষ্টা করে না। আর চেষ্টা করে না বলেই উপরের জ্বালাময়ী লেখা লিখতে হয় কোন কোন মেয়েকে। টিচারকে বয়কট করতে হয় কোন কোন মেয়েকে। এই ঘটনায় আসবো পরের পর্বে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকুন। চলবে।
- বাংলাকথা