স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও স্বীকৃতি পাননি বীরাঙ্গনা কমলা বেগম
মোঃ শাহাদাত হোসেন মনু মোঃ শাহাদাত হোসেন মনু
সিনিয়র সাংবাদিক

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি মেলেনি কমলা বেগমের। ঝালকাঠি সদও উপজেলার শেখেরহাট ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের বীরাঙ্গনা কমলা বেগম এখন পাগল প্রায়। ১৯৭১সালে পাকসেনাদের হাতে ধর্ষণের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটছে তার । পাক বাহিনীর ঔরশে জন্ম নেয়া ছেলেটি হারিয়ে তার মানসিক যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তার বীরাঙ্গনার খেতাব না জোটায় জীবন চলছে রিকশা চালক ছেলের আয়ে আর অন্যের কাছে চেয়ে চিন্তে। মৃত্যুর আগে একমাত্র ছেলের একটু মাথা গোঁজার ঠাই দেখে যেতে চান তিনি। ছেলে রিকশা চালক জামাল মাকে নিয়ে শ্বশুরের দয়ায় একটু ছাপড়া ঘরে কোন মতে দিন কাটাচ্ছেন কমলা বেগম। পাক সেনা ও রাজাকারদের বর্বর নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন তিনি। ঝালকাঠির শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামে এক নিভৃত পল্লীতে থাকেন মানসিক ভারসাম্যহীন বীরাঙ্গনা সুন্দরী কমলা বেগম। শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দুরে শেখেরহাট ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের মরহুম জেন্নাত আলীর ৩য় কন্যা তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ১৪ বছর।
এলাকাবাসি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের খায়েরহাট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপনের ৪/৫ দিন পর এলাকার শামসু মিয়া ও মুনসুর আলী রাজাকার পাকসেনাদের নিয়ে মির্জাপুর গ্রামে কমলা বেগমের বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে রাজাকারদের পাহারা রেখে দলবদ্ধভাবে পাকসেনারা কমলা বেগমের উপরে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। সেই থেকে রাজাকারদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকেন কমলা বেগম। এক মাস পর সুযোগ পেয়ে আত্মীয়স্বজনরা তাকে সরিয়ে ফেলে। কমলাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাকসেনা ও তার দোষরা। এলাকার বাড়ীঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার উদ্যোগ নিলে পাক সেনা বাহিনীতে কর্মরত ওই গ্রামের সন্তান জনৈক মেজরের পিতা পাকসেনাদের বুজিয়ে অগ্নি সংযোগ থেকে বাড়িগুলো রক্ষা করেন।
স্বাধীনতার পরে কমলা বেগম গর্ভবর্তী হয়ে পড়েন। তিনি এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। নাম রাখা হয় কামাল। আত্মীয় স্বজন খুব গোপনীয়ভাবে কমলার জন্ম দেয়া সন্তানকে লালন-পালন করে। ২বছর পর পুত্র কামালকে একটি এতিম খানায় হস্তান্তর করেন। কামাল বড় হলে সে জানে তার মা নেই। ১৮বছর বয়সে কামাল জন্ডিস রোগে অক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এদিকে ভাইয়েরা কমলাকে বেগমকে সদর উপজেলার জৌসার গ্রামের হাসেম আলীর সঙ্গে বিয়ে দেয়। সেই ঘরে তিনি একটি পুত্র ও একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। পরবর্তীতে স্বামী হাসেম আলী এক সময় জানতে পারেন কমলার অতীতের ইতিহাস। এর পরই হাসেম আলী স্ত্রী সন্তানদের রেখে নিরদ্দেশ হয়ে যান। সেই থেকে কমলা বেগম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে স্বামীর সন্ধানে বের হন। হাশেম আলী ও কমলা বেগমের ঘরে জন্ম নেয়া পুত্র রিকশা চালক জামাল তার মাকে শ্বশুরের দেয়া কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামে একখন্ড জমিতে ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন।
সম্প্রতি কমলা বেগমের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, কীর্তিপাশা বাজারেই সব সময় ভবঘুরের মতো হাটা চলা করেন তিনি। মানুষ সময় সময় ভালোবেসে খাবার দেয়। আবার ছেলে জামাল খুঁজে তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। এভাবেই তার জীবন চলছে।
এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার দুলাল সাহা বলেন,“ঝালকাঠির মুক্তিযুদ্ধের সে সময়কার মানুষজন ও মুক্তিযোদ্ধারা সকলেই জানেন বীরাঙ্গনা কমলা বেগমের ইতিহাস। তার আত্মত্যাগ দেশের জন্য অম্লান হয়ে থাকবে। তাকে বীরাঙ্গনা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী করেন তিনি।
ছেলে জামাল মিয়া বলেন,“আমি আমার মায়ের জন্য গর্ববোধ করি। তার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে একাধিকবার আবেদন করেছি। কিন্তু কোন ফল হয়নি। আমি দেশের জন্য আমায়ের মায়ের এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি চাই”।
বীরাঙ্গনা কমলা বেগম জানান,“স্বামী চইল্লা গ্যাছে। মোরে মিলিটারিরা নষ্ট করছে শ্যাহেররআট ক্যাম্পে। মোর আত ধরইর্যা হেইহানে লইয়া গ্যাছে গেছে রাজাকার শামছু ও মুনসুর । হেইর লইগ্যা মোর স্বামী মোগো হালাইয়্যা চইল্লা গ্যছে । মোর ১৮ বছ্ছরের পোলাও মইর্যা গ্যাছে। সরকার কিছ্ছু দেলে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো:আতাহার মিয়া বলেন,“আমরা শুনেছি সে একজন ত্যাগী মানুষ। তার এই স্বীকৃতি আগে পাওয়া উচিত ছিল। তার অতীত ইতিহাস সত্যিই বেদনাদায়ক। আমরা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত তার স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করবো”।