পদ্মা সেতু ৪৫০মিটার দৃশ্যমান ! জানুন কিভাবে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু …
এম. আর. প্রিন্স এম. আর. প্রিন্স
সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
তৃতীয় স্প্যান বসানো হল পদ্মা সেতুতে। প্রথম ও দ্বিতীয় স্প্যানের পর রোববার সকালে পদ্মা সেতুর তৃতীয় স্প্যান বসানো হয় জাজিরা প্রান্তে । ফলে সেতুর ৪৫০ মিটার দৃশ্যমান হল।
৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান ( লম্বা ইস্পাতের কাঠামো)শরিয়তপুর জাজিরা নাউডোবা অংশে ২০১৭ সালের অক্টোবরে এবং চলতি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় স্প্যানটি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলারে বসানো হয়। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং ওজন ৩ হাজার ১৪০ টন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতলবিশিষ্ট কংক্রিটের এই সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর এমন ৪১টি স্প্যান বসানো হবে।
মূল পদ্মা সেতুর সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে জানান, সকাল থেকেই কাজ শুরু হয়ে ভারী ওজনের ভাসমান ক্রেনে ঝুলিয়ে রাখা সেভেন-সি নামে স্প্যানটি ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে । তিনি আরও বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তৃতীয় স্প্যান বসানো হয়েছে। এখন ওয়েল্ডিংয়ের সাহায্যে দুটি স্প্যানের জোড়া লাগানো কাজ শেষ হতে আরও কিছু সময় লাগবে। ৪১ নম্বর পিলারটিও চতুর্থ স্প্যান বসানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে । স্প্যান বসানোর কর্মযজ্ঞ সরাসরি স্ব-চোখে দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ পদ্মা নদীর তীরে ভিড় করে । সফলভাবে স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখে তাদের উচ্ছ্বাস ও উল্লাস লক্ষ্য করা যায় । ৫ই ফ্রেরুয়ারী ২০১৮ একটি অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকেই পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হতে পারে।
সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে যে স্বপ্ন ঘুমাতে দেয়না সে স্বপ্ন ‘পদ্মা সেতু’র ৪৫০মিটার এখন দৃশ্যমান ! সরোজমিনে ঘুরে দেখা গেছে দুই পাড়ের বিশাল এলাকা জুড়ে সু-বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং এ যাবৎ প্রায় সমাপ্ত সংযোগ সড়ক সহ বিবিধ কাজের দৃষ্টিস্নাত সৌন্দর্য মন্ডিত দৃশ্যায়ণ ।এ যেন বিশ্ব দুনিয়ায় অন্য এক বাংলাদেশ উকি দিচ্ছে । কথা হয়েছে সড়ক পথে আসা বরিশাল এবং পটুয়াখালীর কয়েকজন সাধারণ মানুষের সাথে, তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন শেষ হবে বৈরী আবহাওয়ায় ঝুকিপূর্ণ লঞ্চ, ফেরী কিংবা স্পিডবোটে বিশাল পদ্মা নদী পারাপার । পটুয়াখালীর ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, “ পদ্মা সেতু চালু হলেই আমাদের অনেক পথ ও সময় বেঁচে যাবে ।” বরিশালের কয়েকজন বেশ উৎফুল্ল চিত্তে বলেন, “ সাগর বিধৌত নদ-নদী বেষ্টিত দক্ষিণ বাংলায় রেললাইন হবে যা কখনই ভাবনায় ছিলোনা, শুনেছি আধুনিক রেললাইন বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত যাবে, রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ খুব কম সময় ও সহজ হওয়ায় সমগ্র বরিশাল বিভাগ অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাবে ।”
এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মোঃ শহীদুজ্জামান বলেন, “পদ্মা সেতু হয়ে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্র বন্দর ও নয়ানাভিরাম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা সহ সমগ্র বরিশাল বিভাগ আরও অর্থনৈতিক ভাবে গতি পাবে এবং অত্র অঞ্চলকে মনে হবে ২য় সিঙ্গাপুর ।” উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক(ডিআইজি)বরিশাল রেঞ্জ, মোঃ শফিকুল ইসলাম (বিপিএম) বলেন, “যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি দ্রুত ও আধুনিক হলে আইন শৃংখলারও অনেক উন্নতি সাধিত হয় ।পদ্মাসেতু বাস্তবায়নে সামগ্রিক ক্ষেত্রেই উন্নতি ও সুবিধে হবে ।”
২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকতা এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হওয়া বড় প্রকল্প পদ্মা বহুমূখী সেতু হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে । নানা আলোচনা সমালোচনা, বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বড় সংকট সহ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৮ সালের ১১ই মার্চ এখন পদ্মা সেতুর ৪৫০ মিটার দৃশ্যমান । এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ এর সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে, ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে । দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে । যার ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচে দিয়ে আধুনিক ট্রেন চলবে । কিন্তু এখনই রেল লাইন নির্মান অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল চিনের এক্সিম ব্যাংকের সাথে সুদের হার বনিবনা না হওয়ায় । আশার কথা একটি সূত্র থেকে জানা যায়, চিনের এক্সিম ব্যাংক সম্প্রতি দর কষাকষি শেষে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ২% সুদের হার মেনে নিয়ে অনুমতি দিয়েছে । কিন্তু সময় নষ্ট হয়েছে অনেক । তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন রেল চলবে না । ২০২২ সালের মধ্যে রেল চলবে এবং দীর্ঘ চলার পথ ছোট বড় নদ-নদী সহ নানা জটিলতা থাকায় রেল লাইন বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর পায়রা পর্যন্ত নির্মাণ হতে সময় প্রয়োজন হবে ।
দুই পাড়ের সংযোগ সেতুসহ সেতুটি হবে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ । মূল ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুতে থাকবে মোট ৪২টি পিলার। এরমধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দু’টি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিলার থেকে আরেকটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। তবে শুরু থেকেই নদীর মাওয়া প্রান্তে মাটির তলদেশের গঠন বৈচিত্রের কারণে দৈর্ঘ্য নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এই প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের কাজ ধরা হলেও পরে তা অর্ধসমাপ্ত রেখেই কাজ সরিয়ে নেয়া হয় জাজিরা প্রান্তে। মাওয়া প্রান্তে ১ নম্বর এবং ৬ থেকে ১২ নম্বর পিলারের দৈর্ঘ্য কত হবে তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। ফলে অন্য পিলারগুলোতে কাজ ধরা হলেও বন্ধ আছে কয়েকটি পিলারের কাজ। তবে সম্প্রতি সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানালেন, ইতিমধ্যেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বের সর্বোচ্চ সারে তিন হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হাইড্রোলিক সর্বোচ্চ টেকনোলজি পৃথিবীর সেরা হ্যামার প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে । এর আগে যোগ হয়েছে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন একটি হ্যামার। এ হ্যামার প্রায় দেড়মাস সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জুন মাসে মাওয়ায় এসে পৌঁছে । জার্মানিতে তৈরি এই হ্যামার জাজিরা প্রান্তে পাইলিংয়ের কাজে এবং আগের দুটি হ্যামার ব্যবহার হবে মাওয়া প্রান্তে।
ইতিমধ্যে পদ্মাসেতু নিয়ে অনলাইন নিউজ ভার্সন গুলোতে অনেক জানা অজানা নিউজ হয়েছে । আবার অনেক নিউজ নিয়ে সর্বমহলে হয়েছে রহস্য ও তোলপাড় । যেমন বলা হয়েছে “পদ্মা সেতু নির্মানে অনিশ্চয়তা, নদীর তলদেশের দানব গিলে ফেলছে পিলার, গাঁথা যাচ্ছে না পিলার।” “পদ্মার নিচে আরেকটা পদ্মার অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে ।” “পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির গভীরে যখন পিলার গাঁথা হয়, সেসব পিলার কোথায় যে হারিয়ে যায় তার কোন হদিস নেই।” প্রকল্প পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, পৃথিবীর দুটি প্রাকৃতিক জটিলতাপূর্ণ নদীর মধ্যে পদ্মা একটি । পদ্মার প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। নদীর তলদেশে মাটির স্তরের গঠন নিয়ে জটিলতা কাটিয়ে প্রবল স্রোতকে উপেক্ষা করে এ নির্মাণ কাজ চলছে। সব ধরনের প্রতিকূলতা জয় করে মূল সেতুর পাইলিংয়ের কাজ চলছে পদ্মার দুই পাড়েই।জাজিরা অংশে সব পিলারের পাইলিংয়ের মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গেছে । সম্প্রতি দেশি বিদেশি পরামর্শকরা সকল সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন । পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সফর শেষে দেশে ফেরার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণ সহজ কথা নয়। অনেক স্রোত নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ, সেই দুর্যোগ মাথায় নিয়েও এগোচ্ছি। তাছাড়া অনেক উন্নত দেশ যা পারেনি, শত বাধার মুখেও নিজেদের অর্থায়নে বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে বলেও মত দেন তিনি ।”
পদ্মা সেতুর অগ্রগতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল সেতুর চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। পুরো প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এটি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড নামক এক কোম্পানী । আর নদী শাসন দায়িত্বে রয়েছে কোরিয়ান কোম্পানী । প্রকল্পে সেতু নির্মানের সব কাজ তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল । নিরাপত্তার কারনে ভিতরে গিয়ে সকলের কাজ দেখাও সম্ভব নয় । সংবাদ সংগ্রহে যেতে আগেই অনুমতি নিতে হয় । শুরুতে নির্বাহী প্রকৌশলীরা সহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই তথ্য উপাত্ত দিতে পারতেন । কিন্তু বর্তমানে একমাত্র প্রকল্প পরিচালক ছাড়া আর কারও গণমাধ্যমের সাথে তথ্য বিনিময় করা নিষেধ । তাই সবসময় প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামকে কথা বলতে দেখা যায় । বিশেষ পরিচয় না থাকলে অনেকের পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা খুবই কষ্টসাধ্য ।
মুন্সীগজ্ঞ জেলার মাওয়া, মাদারীপুর জেলার শিবচর ও শরীয়তপুর জেলার জাজিরায় চলছে স্বপ্ন বাস্তবায়নের উৎসব । দিন রাত পুরোদমে কাজ চলছে পদ্মা নদীর পাড়ে । প্রতিদিন ৫ হাজার লোক কাজ করছেন । জাজিরা প্রান্তে কাঠাল বাড়ী ঘাট এখন দারুণ দৃশ্যপট । জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সকল আধুনিক নাগরিক সুবিধাসহ পূর্ণাবাসন কেন্দ্রগুলো রাস্তার পাশে সবুজের সমারোহে শোভা পাচ্ছে । দীর্ঘ এই পদ্মা সেতু যানবাহনকে পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ১৫ মিনিট । এই সেতু প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক(পিডি)গণমাধ্যমকে আরও বলেন, “ পদ্মা সেতুর বাহিরের রং হবে সোনালি। তবে রাতে সেতুটিতে জ্বলবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে লাল ও সবুজ বাতি। সেভাবেই সেট করা হবে ভাল্ব গুলো । প্রতিটি স্প্যান পদ্মা নদীর পানির স্তর থেকে ৫০ ফুট উঁচুতে বসবে ।”